বুক জ্বালা-পোড়া করলে কী করবেন?
আপনার কি বুক জ্বালা-পোড়া করে? গলায় জ্বলুনি হয়? কিংবা গলার ভেতরের দিকে ঝাল, টক বা লবণাক্ত কোনো তরলের অস্তিত্ব অনুভব করেন? সেই সঙ্গে ঢেকুরও তোলেন? তাহলে ধরে নিতে পারেন, এগুলো গ্যাসের সমস্যা থেকে তৈরি হয়েছে। আর এ লেখাটি আপনার জন্যই লেখা হয়েছে।
মাঝেমধ্যে বুকের মাঝখানে জ্বালা-পোড়াকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে (Heartburn) হার্ট বার্ন বলে। যদিও এটি হূৎপিণ্ডের সমস্যা নয়। এই রোগের মূল কারণ হিসেবে গ্যাস্ট্রো ইজোফ্যাকাল রিফ্লেক্স ডিজিজ (Gastroesophageal Reflux Disease ) বা সংক্ষেপে গার্ড (GERD) কে দায়ী করা হয়। সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতিদিন ২৫ মিলিয়ন লোক এবং ৪০ শতাংশ পূর্ণবয়স্ক নারী-পুরুষ জীবনের যেকোনো সময়ে এ উপসর্গে ভুগে থাকেন। গর্ভকালীন ৪০ থেকে ৮০ শতাংশ গর্ভবতী মায়ের এ সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
ঝুঁকি:
যাঁরা এ উপসর্গে ভোগেন, তাঁদের মধ্যে ৯৪ শতাংশ ব্যক্তি খাবারের তারতম্যের কারণে এবং ৫০ শতাংশ ব্যক্তি মানসিক চাপের কারণে এ সমস্যায় পড়েন। অ্যালকোহল, কালো গোলমরিচ, চকলেট, কফি, কোমল পানীয়, সিরকা, তৈলাক্ত খাবার, ভাজাপোড়া, আচার, টমেটো সস, কমলার রস, পেঁয়াজ, পিপারমিন্ট ইত্যাদি এই উপসর্গ বাড়ায়। খাবার গ্রহণের পরপরই শুয়ে পড়া বা ব্যায়াম করা ভালো নয়। পাকস্থলীর ওপর চাপ। যেমন একসঙ্গে বেশি খাদ্য গ্রহণ, স্থূলতা, গর্ভাবস্থা, শক্ত বেল্টের প্যান্ট পরা। দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ ও ধূমপান।
বুক জ্বালা পোড়া করলে আপনার করণীয় কী?
খাদ্য গ্রহণের পর তা খাদ্যনালীর ভেতর দিয়ে পাকস্থলীতে এসে পৌঁছায়। খাদ্যনালীর নীচের অংশে থাকে বিশেষ ধরনের একটি মাংসপিন্ড। স্বাভাবিক অবস্থায় এটি ভালভ বা গেইটের ন্যায় প্রয়োজন মত উন্মুক্ত হয়ে বা বন্ধ হয়ে খাদ্যদ্রব্যকে পাকস্থলীতে পৌঁছুতে সাহায্য করে। সেইসাথে পাকস্থলীর ভেতরের খাদ্যবস্তু পুনরায় খাদ্যনালীর ভেতর ফিরে আসতে বাঁধা দেয়। খাদ্যদ্রব্য হজমের জন্য পাকস্থলীতে এসিডের নিঃসরণ ঘটে। আমাদের খাদ্যদ্রব্য হজম করার জন্য পাকস্থলীতে এসিড, পিত্তরস এবং পেপসিন সহ বেশ কিছু উপাদান থাকে। এ সব উপাদান নানা কারণে খাদ্য নালীতে ঢুকে পড়লে এবং সেখানে দীর্ঘ সময় অবস্থান করলে পরিণামে খাদ্যনালীর যে আবরণ আছে তার ক্ষতি হয়। আর এ কারণেই গলা জ্বালা বা বুক জ্বালার মত উপসর্গ দেখা দেয়। পাকস্থলী থেকে যে সব তরল উপাদান খাদ্যনালীতে এসে জমা হয় তার মধ্যে এসিড থাকার কারণেই এ ধরণের ক্ষতি হয়। পেপসিন বা পিত্তরস এ ক্ষেত্রে কতোটা ক্ষতি করে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় নি।
কিন্তু কখনও কখনও কোন কারণে এই ভালভটি দুর্বল বা অকার্যক্ষম হয়ে পড়লে এই এসিড পশ্চাৎ দিকে অর্থাৎ গলা বা খাদ্যনালীর (ইসোফেগাস) দিকে নির্গত হয় তখন একজন ব্যক্তি ‘এসিড রিফ্লাক্স’ বা জিইআরডি রোগে আক্রান্ত হয়। যেহেতু এই এসিড খাদ্যনালীর প্রভূত ক্ষতি সাধন করতে পারে তাই সঠিক সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা করা না হলে রোগটির মাত্রা এবং এ সংক্রান্ত জটিলতা বৃদ্ধি পেতে পারে এবং তা দীর্ঘস্থায়ী রূপ লাভ করতে পারে। এমনকি তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে কোন কোন ক্ষেত্রে খাদ্যনালীর প্রচন্ড ক্ষতি সাধিত হতে পারে, তীব্র প্রদাহ দেখা দিতে পারে এমনকি খাদ্যনালী অত্যন্ত সরু হয়ে যেতে পারে। দাঁতের বহিরাবরণ, গলার কোষকলা এবং শ্বাসনালীর বায়ু চলাচলের পথও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে।
এই রোগের প্রধান লক্ষণ খাদ্যনালী, বুক বা গলায় জ্বালা অনুভূত হওয়া যা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে বেশ কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে। এ রোগের অন্যান্য লক্ষণগুলো হলো; দীর্ঘস্থায়ী কাশি, গলায় ক্ষত, পাকস্থলী ভার হয়ে থাকা, খাওয়ার পর বমিভাব এবং পেটের উপরের অংশে ব্যথা বা অস্বস্তি অনুভূত হওয়া, খাদ্য গ্রহণের পর কখনও কখনও তরলের ন্যায় ঝাঁঝালো কিছু পদার্থ উপরের দিকে উঠে আসা ইত্যাদি।
দীর্ঘদিন ধরে এসিড রিফ্লাক্সে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে কখনও কখনও ‘ব্যারেটস্ ইসোফেগাস’-এ আক্রান্ত হয়ে পড়তে দেখা যায়। ‘ব্যারেটস্ ইসোফেগাস’ বলতে খাদ্যনালীর জটিল এক অবস্থকে বোঝানো হয়। এক্ষেত্রে খাদ্যনালীর অভ্যন্তরস্থ কোষকলার মধ্যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দেয় যা পরবর্তীতে ক্যান্সারে রূপান্তরিত হয়ে উঠতে পারে। এই অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য এন্ডোস্কপি করার সময় কোষকলার নমুনা সংগ্রহ করে বায়োপসি করা হয়। তবে ক্যান্সারের পূর্বাবস্থা থেকে কোষকলাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কোন পদ্ধতি বা চিকিৎসা এখনও আবিষ্কার করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
যেসব লক্ষ্যকে সামনে রেখে পাকস্থলীর চিকিৎসা আরম্ভ করা প্রয়োজন সেগুলো হলো পাকস্থলীতে সৃষ্ট এসিডের বিপরীত দিকে অর্থাৎ খাদ্যনালীর দিকে প্রবাহ রোধ করা, খাদ্যনালীর অভ্যন্তরস্থ আস্তরণের কোষকলার ক্ষতি রোধ করা অথবা ইতিমধ্যে সাধিত ক্ষতি সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা, আরোগ্য লাভ করার পর পুনরায় রোগটি ফিরে আসা রোধ করা, এসিড রিফ্লাক্সের কারণে শরীরে যাতে অন্য কোন সমস্যার সৃষ্টি না হয় অথবা বিভিন্ন ধরনের জটিলতা বৃদ্ধি না পায় সেই চেষ্টা করা।
ঔষধ সেবনের মাধ্যমে অথবা খাদ্য গ্রহণে কিছু নিষেধাজ্ঞা মেনে চলে এবং জীবনযাপনের ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন এনে এই রোগের লক্ষণ ও তীব্রতা অনেকাংশে লাঘব করা যায়। এ্যান্টাসিড এই রোগে বেশ কার্যকর হয়ে থাকে কারণ এ্যান্টাসিড খাদ্যনালীর দিকে চলে আসা এসিডকে নিস্ক্রিয় করে তোলে। এছাড়া ‘এইচ-২ ব্লকার’ অথবা ‘প্রোটন পাম্প ইনহিবিটরস্’ পাকস্থলীতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত এসিড নিঃসরণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। ফলে বুক জ্বলা, পাকস্থলীর ব্যথা, অনবরত কাশি এবং ঘুমের ব্যাঘাতজনিত সমস্যার লাঘব ঘটে।
অসুখের মাত্রার উপর নির্ভর করে দীর্ঘদিন চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। ঔষধ এবং অন্যান্য পদ্ধতি অনুসরণ করার পরও যদি অসুখের লক্ষণ প্রশমিত না হয় অথবা পুনরায় ফিরে আসে তবে সেক্ষেত্রে অস্ত্রপোচারের প্রয়োজন হতে পারে।
জেনে নেবো এসিডিটির হাত থেকে রক্ষা পেতে প্রয়োজনীয় বন্ধু খাবারের নামঃ
সকালের নাস্তায় রাখতে পারেন চিড়া, দই, ওটমিল। ফল খেতে পারেন পাকা কলা, ফুটি বা বাঙ্গি। চিড়া, মুড়ি এগুলোরও রয়েছে এসিড শুষে নেওয়ার ভালো ক্ষমতা।
তেল, ভাজি পোড়া যত পারুন কম খান। বাইরের সুস্বাদু খাবার দেখলেই খেতে চাওয়ার ইচ্ছা সামলাতে হবে।
আমিষের মাঝে ডিম বা মাছে কোন সমস্যা নেই। মুরগী নিয়েও কোন আপত্তি করেন না ডাক্তাররা। গরু-খাসী খেতে হলে যথাসম্ভব তেল বাদ দিয়ে রান্না করতে হবে।
সালাদ যদি হয় টমেটো বা পিয়াজ ছাড়া তবে খেতে পারেন যত খুশি।
ভেষজ উদ্ভিদ ঘৃতকুমারী আমাদের খুব পরিচিত একটি নাম। ঘৃতকুমারীর শরবতের সুনাম রয়েছে বুকের জ্বালা পোড়া কমাতে।
পানীয়ের মাঝে নিতে পারেন লেবু বা কমলা ছাড়া আপেল জুস, ম্যাঙ্গো জুস, বেরি জুস। কোল্ড ড্রিঙ্কস বাদ দিয়ে পান করুন পানি বা হারবাল চা।
ফুলকপি, পাতাকপি, আলু, ব্রুকলি, শালগম, লাউ, কুমড়া, সবুজ বিভিন্ন শাক প্রভৃতি সবুজ সবজি খেতে পারেন নির্দ্বিধায়।
দুধে সমস্যা না থাকলেও দুগ্ধজাত মাখন, ঘি নিয়ে ঝামেলা আছে। মাখন, ঘি, পনির খেলে হিসাব রেখে খাবেন।
শহুরে ব্যাস্ত মানুষের কিছু টিপস-
১) নিজেকে তৃষ্ণার্ত হতে দিবেন না- সাথে সব সময় একটি পানির বোতল রাখুন। স্কুলে আমরা সবাই পড়েছি দৈনিক ৮ গ্লাস পানি বাধ্যতামূলক। এর বেশি খেলে কোন উপকার বৈ অপকার নেই। বেশি বেশি পানি খাওয়ার অভ্যাস করুন।
২) সকালের নাস্তা বাদ দিবেন না- ব্যাস্ততায় আমরা প্রায়ই সকালের নাস্তা বাদ দেই। খাবার বাদ দাওয়া কখনোই ভালো কিছু না। বিশেষ করে সকালের নাস্তা। দুপুরে কম খান, রাতেও তুলনামূলক অল্প খান। কিন্তু সকালের নাস্তাটা হওয়া উচিত ভারী।
৩) বিরতিতে হালকা নাস্তা খেতে পারেন- হালকা টুকটাক নাস্তা (স্ন্যাকিং) এর চর্চা রাখা ভালো। বড় ব্যাবধানে বিশাল ভূরিভোজনের চাইতে স্বল্প বিরতিতে টুকটাক নাস্তা খেতে পারেন। এতে পাকস্থলি ভালো থাকে। খেয়াল রাখবেন অতিরিক্ত ভাজাপোড়া, মাত্রারিক্ত চিনিযুক্ত ও বাইরের খাবার যেন না খাওয়া হয়।
৪) দেহকে সচল রাখুন- ব্যাস্ত জীবনে ব্যায়ামের জন্য আলাদা করে সময় যোগার করা বেশ কষ্টসাধ্য। তারচেয়ে বরং রিকশার বদলে হাঁটা শুরু করুন। লিফট এর বদলে সিঁড়ি ব্যাবহার করুন।
৫) রঙ চা পানের অভ্যাস করুন- রঙ / লাল / লিকার / গ্রিন চা এর উপকারিতা অনেক। দুধ – চিনি যুক্ত চা হতে আস্তে আস্তে রঙ চা পানের অভ্যাস করুন।
৬) খাবারে আঁশের পরিমাণ বাড়ান- ফলমূল, দই, লাল আটা ইত্যাদিতে প্রচুর ফাইবার বা আঁশ রয়েছে। আঁশ পরিপাকের জন্য অত্যন্ত ভালো। আঁশযুক্ত স্যুপ / ঝোল সহজেই বানানো সম্ভব এবং পুষ্টিগুণেও এর জুড়ি মেলা কঠিন।
কখন ডাক্তার দেখাবেন:
১. যদি আপনার বুকে খুব বেশি জ্বালা পোড়া হয়, কিংবা ব্যথাটা বুক থেকে আপনার বাহু এবং কাধের দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সেক্ষেত্রে এটা হয়তো হার্ট এ্যাটাকের লক্ষণ।
২. যদি আপনি উপরের পরামর্শগুলো পালন করে থাকেন এবং তারপরও আপনার বুকের জ্বলা পোড়া বন্ধ না হয়।